সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৪:৩৩ পূর্বাহ্ন
Reading Time: 2 minutes
কামরুল হাসান, ময়মনসিংহঃ
আজ ২৭ নভেম্বর ২০২১ এশিয়ান মিউজিক মিউজিয়ামে ময়মনসিংহে ঐতিহ্যবাহী লোকায়ত সংগীত বাউল সমিতি অনাড়ম্বর এক সংগীত অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। বিকাল ৪ টায় শুরু হয়ে রাত ৯ টায় অনুষ্ঠান শেষ হয়। নদীমাতৃক সুজলা-সুফলা শস্য-শ্যামলা আমাদেরই এই দেশকে নিয়ে গর্ব আদিকাল থেকেই। এদেশের সংখ্যা গরিষ্ঠদের পেশা কৃষি। মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বী সহ অন্যান্য অনেক সম্পদায়ের মানুষের বসবাস রয়েছে এদেশে। বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে রয়েছে সম্প্রতির মেলবন্ধন। এদেশে রয়েছে বিভিন্ন ধর্মের, বর্ণের, বিভিন্ন ভাষা ও বিভিন্ন সংস্কৃতির মানুষ। একে অন্যের অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত হয়ে সুখ, দুঃখ, হাসি-কান্না, আনন্দ-বেদনা ভাগাভাগি করে নেয়। বাংলাদেশের সংস্কৃতিরও রয়েছে এক গৌরবউজ্জল ইতিহাস। আমাদের সংস্কৃতিই আমাদের বলে দেয় যে আমরা বাঙালি। সময়ের পরিক্রমায় বাংলাদেশের বাউল গান বিশ্ব দরবারে আমাদেরকে করেছে সর্বোচ্চ সম্মানের আসনে।
জাতিসংঘের শিক্ষা ও গবেষণা সংস্থা ইউনেস্কো তার সদর দপ্তর প্যারিস থেকে ২০০৫ সালের ২৭ নভেম্বর এক বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী বাউল গানকে মানবতার ধারক হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। সারা বিশ্বের ৪৩টি বাক ও বিমূর্ত ঐতিহ্য চিহ্নিত করতে গিয়ে ইউনেস্কো বাংলাদেশের বাউল গানকে অসাধারণ সৃষ্টি বলে আখ্যা দিয়ে একে বিশ্ব মানবতার ঐতিহ্যের ধারক বলে ঘোষণা দেয়। ফলে বাউল গান নিয়ে দেশে-বিদেশে ব্যাপক আগ্রহের সৃষ্টি হয়।
বাউল গান সাধারণতঃ প্রান্তিক জনগোষ্ঠী অনেক উৎসাহ ও উদ্দীপনা নিয়ে শ্রবণ করে। বাউল গান সহজ সরল ভাষায় প্রান্তিক জনগণের সুখ, দুঃখ, আনন্দ হাসি, কান্না, মানুষের জীবন জিজ্ঞাসার কথা তুলে ধরে। এই গানের মধ্যদিয়ে কল্যাণের কথা, মানবতার কথা, সমাজ সংস্কারের কথা, সাম্যের কথা, অর্থনীতির কথা, উন্নয়নের কথা, একাগ্রতার কথা ফুটে ওঠে। বাউল গানের শিক্ষায় দিক্ষীত না হলে কারো পক্ষে এই নিগূঢ় তত্ত্ব অনুধাবন করা অসম্ভব।
বহুমুখীর প্রতিভার অধিকারী একজন বাঙালি সমাজ সংস্কারক, মানবতাবাদী, দার্শনিক বাউল সাধক ফকির লালন শাহ গেয়েছেন,
“চাঁদের গায়ে চাঁদ লেগেছে আমরা ভেবে করবো কি
ঝিয়ের পেটে মায়ের জন্ম তারে তোমরা বলবে কি ?
তিন মাসের এক কন্যা ছিল নয় মাসে তার গর্ভ হল
এগার মাসে তিনটি সন্তান কে বা করবে ফকিরি ?
ঘর আছে তার দুয়ার নাই লোক আছে তার বাক্য নাই রে
কে বা তারে আহার জোগায় কে বা দেয় সান্ধ্যাবাতি ?
ফকির লালন ভেবে বলে ছেলে মরে মাকে ছুঁলে
এই তিন কথার আর্থ নইলে তার হবে না ফকিরি ।”
বাউলসাধকদের সাধনার মাধ্যম হচ্ছে গান। নিজ দেহের মধ্যে স্রষ্টাকে পাওয়ার তীব্র ব্যাকুলতা থেকে বাউল ধারার সৃষ্টি। সাধকের কাছে সাধন-ভজনের গূঢ়তত্ত্ব প্রকাশ পায় গানের মাধ্যমেই। প্রত্যেক মানুষের অন্তরে যে পরম সুন্দর ঈশ্বরের উপস্থিতি, সেই অদেখাকে দেখা আর অধরাকে ধরাই বাউল সাধন-ভজনের উদ্দেশ্য। ইহজাগতিক কিংবা পারলৌকিক কোনো প্রাপ্তির জন্য বাউল সাধন-ভজন করে না। একান্ত মানবিক ও আধ্যাত্মিক চেতনার বশবর্তী হয়ে তাঁরা ধর্মাচার করেন। পুঁজিবাদী বা সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রয়োজন তাঁদের নেই। অন্যের জমি দখল করে মসজিদ, মন্দির নির্মাণের প্রয়োজনও তাঁদের নেই। বাউলের ভূখণ্ড বলতে তাঁর দেহ, পথপ্রদর্শক তাঁর গুরু, জীবনসঙ্গী নারী, সাধনপথ বলতে সুর, আর মন্ত্র বলতে একতারা।
অনুষ্ঠানে সাধারণ সম্পাদক রেজাউল করিম আসলাম তার বক্তব্য বলেন বাউল গান বিশ্বমানবতার ধারক ইউনেস্কোর স্বীকৃতি পাওয়ার ১৬ বছর পরও অনেকেই তা জানেনা। ইউনেস্কো আমাদের সঠিক স্বীকৃতি দিয়েছে। বাউল গান এই স্বীকৃতি পাওয়ার যোগ্য।
তিনি আরও বলেন, যে দেশে গুণী লোকের কদর করা হয় না, সেদেশে গুণী লোক জন্মায় না। আমাদের অনেক সীমাবদ্ধতা আছে সত্য তবু দায়বদ্ধতা ও দায়িত্ববোধের জায়গা থেকে আমাদের সকলকে বাউল গানের প্রচার ও প্রসারে একে অন্যকে সহযোগিতা করার মনোভাব নিয়ে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে একসাথে কাজ করার আহব্বান জানিয়ে অনুষ্ঠানের সমাপ্তি ঘোষনা করেন।